উঃ- ভারতীয় সভ্যতার মূলগত ঐক্য (Fundamental Unity of Indian Civilization) : উত্তরে হিমালয়, দক্ষিণে কন্যাকুমারী এবং পশ্চিমে আরব সাগর থেকে পূর্বে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ভূ-ভাগ ভারতবর্ষ হল বৈচিত্র্যের লীলাভূমি। প্রাকৃতিক পরিবেশ, জনগোষ্ঠী, ভাষা, ধর্ম, সামাজিক আচার আচরণ, পোষাক-পরিচ্ছদ ও জীবনযাত্রা প্রণালী- সব দিকেই এই বৈচিত্র্যের পরিচয় সুস্পষ্ট। এই সীমাহীন বৈচিত্র্যের প্রতি ইঙ্গিত করে ভারতের ইতিহাস ঐতিহাসিকরা ভারতকে 'বিশ্বের সারাংশ' ('epitome of the world') বলে অভিহিত করেছেন। প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক প্রতিবন্ধকতা এবং জাতি, ভাষা, ধর্ম ও অন্যান্য পার্থক্যের কারণে প্রাচীন যুগে ভারতে কোনও অখণ্ড রাজনৈতিক সাত্তা গড়ে উঠতে পারে নি। প্রাচীন গ্রিসের মতো ভারতের বুকে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আঞ্চলিক রাজা। ব্রিটিশ শাসনেই ভারতবর্ষ অখণ্ড রাজনৈতিক ঐকা লাভ করে এবং স্বাধীনতার পর এই ঐক্যের বন্ধন সুদৃঢ় হয়। এ সত্ত্বেও কিন্তু বলতে হয় যে, বিভেদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠাই হল ভারতীয় সাধনার মর্মবাণী।
■ বৈচিত্র্যের লীলাভূমি ভারত। ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক দিক থেকে ভারতের বৈচিত্র্যা সীমাহীন। উত্তুঙ্গ পবর্তমালা, উত্তাল সমুদ্র, নদীমাতৃক শস্য-শ্যামলা বিস্তীর্ণ সমভূমি, অসংখ্যা নদ-নদী, গহন অরণ্যানী, দিগন্ত-বিস্তৃত ঊষর মরুভূমি ভারতকে এক অপরূপ বৈচিত্র্যে পূর্ণ করেছে। জলবায়ু ও আবহাওয়ার দিক থেকেও ভারত বৈচিত্র্যময়।
(১) ভৌগোলিক বৈচিত্র্যা:- তুষারাবৃত হিমালয়ের প্রবল শৈতা, মরু অঞ্চলের প্রবল উত্তাপ, বাংলার নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া এক কথায়, মরুদেশীয় আবহাওয়া (Polar climate), পরিমিত আবহাওয়া (Terrperate climate) এবং গ্রীষ্মকালীন আবহাওয়া (Tropical climate) - সবই ভারতের বুকে বিদ্যমান। বৃষ্টিপাতের ক্ষেত্রেও ভারতে প্রবল পার্থক্য দেখা যায়। মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে (মৌসিনরাম গ্রাম) বছরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১২৫০ সেমি.। আবার অন্যদিকে সিন্ধু ও রাজপুতানার মরু অঞ্চলে বৃষ্টিপাত বছরে মাত্র ১০ থেকে ১৫ সেমি.। ভূপৃষ্ঠের উচ্চতা, অক্ষাংশ, জলবায়ুর উচ্চতা ও আর্দ্রতা প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা ধরনের ও নানা শ্রেণির গাছপালা, লতা-গুল্ম, বৃক্ষ এবং পশু-পাখি ও পোকা-মাকড় দেখা যায়। প্রকৃতি বিজ্ঞানে বর্ণিত উদ্ভিদ ও জীবজন্তুর প্রায় সকল প্রজাতির নমুনাই ভারতে আছে।
(২) জাতিগত বৈচিত্র্য: প্রাকৃতির বৈচিত্র্যের মতো ভারতে জনগোষ্ঠীর বৈচিত্রও নেহাত কম নয়। ভারতের জনসংখ্যা হল বিশ্বের এক-ষষ্ঠাংশ। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস লেখেন যে, বিশ্বে ভারতের জনসংখ্যা সর্ববৃহৎ। যুগ যুগ ধরে বহুবিদেশি জাতি ও উপজাতি ভারতে প্রবেশ করেছে। দ্রাবিড়, আর্য, পারসিক, গ্রিক, শক, পহ্লব, কুষাণ, আরব, তুর্কি, আফগান, মোঙ্গল এবং বিভিন্ন ইউরোপীয় জাতিগোষ্ঠীর সমবায়ে ভারতীয় মহাজাতি গড়ে উঠেছে। ভারতের আদিম অধিবাসী কোল, ভিল, মুণ্ডা, গোগু, সাঁওতাল প্রভৃতি শিকার-নির্ভর, অরণ্য-সম্ভান থেকে শুরু করে শহরবাসী অতি-আধুনিক চিন্তাধারার মানুষরা এই মহাজাতির অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বের সকল জাতিগোষ্ঠীর মানুষই ভারতে বিদ্যমান এবং এইসব বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে নিয়ে ভারতে এক 'মিশ্র সংস্কৃতি' গড়ে উঠেছে। ডঃ স্মিথ তাই ভারতকে 'নৃতত্ত্বের যাদুঘর' বলে অভিহিত। করেছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ-এর কথায় ভারত হল 'মহামানবের সাগর'।
(৩) ভাষাগত বৈচিত্র: ভারতে ভাষাগত পার্থক্যও বিরাট। ভারতে ভাষার সংখ্যা ১৭৯ এবং উপভাষার সংখ্যা ৫৪৪টি। যে সব ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতির যোগ আছে এবং যেগুলির ব্যবহারও সর্বাধিক, তার সংখ্যা মাত্র ১৫। উত্তর ভারতের ভাষাগুলির মধ্যে হিন্দি, বাংলা, মারাঠি, গুজরাটি, রাজস্থানী, অহমিয়া, ওড়িয়া এবং সাক্ষিণাত্যের ভাষাগুলির মধ্যে তামিল, তেলেগু, মালয়ালাম, বড় প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। উত্তর ভারতের ভাষাগুলি মূলত সংস্কৃত ও প্রাকৃত থেকে এবং দাক্ষিণাত্যের ভাষাগুলি প্রাবিড় থেকে উৎপন্ন হয়েছে।
(৪) ধর্মপিত বৈচিত্র্য: ধর্মের দিক থেকেও ভারতবাসীর বৈচিত্র্য নজরে আসার মতো। বিশ্বের প্রধান প্রধান প্রায় সকল ধর্মমতই ভারতে বিদ্যমান। হিন্দু, ইসলাম, জৈন, বৌদ্ধ, শিখ, খ্রিস্টান জাতির এবং আরও নানা ধর্মমত ভারতে প্রচলিত। ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হিন্দুধর্মাবলম্বী হলেও এই ধর্মের মধ্যে নানা বিভাজন, সম্প্রদায়, নানা প্রথা, নানা সংস্কার ও নানা দেবতার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। এই ধর্ম বৈদিক, পৌরাণিক, শৈব, বৈষ্ণব, একেশ্বরবাদ, দ্বৈত-অদ্বৈত-বিশিষ্টাদ্বৈত, সাকার-নিরাকার, আর্য সমাজ, ব্রাহ্ম সমাজ প্রভৃতি নানা সম্প্রদায় ও মতবাদে বিভক্ত। বৌদ্ধধর্ম আবার মহাযান ও হীনযান, জৈনধর্ম শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর প্রভৃতি সম্প্রদায়ে বিভক্ত। ইসলাম ধর্ম শিয়া- সুন্নি এবং খ্রিস্টান ধর্ম ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ে বিভক্ত। ভারতের আদিন অধিবাসীগুলির আবার নিজস্ব পৃথক পৃথক ধর্মমত আছে।
(৫) সামাজিক বৈচিত্র্য: সামাজিক বিন্যাস, জীবনযাত্রা প্রণালী, জীবনচর্যা, পোশাক-পরিচ্ছদ, দ্বারা প্রভৃতির দিক থেকেও ভারতবাসীর মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। ভারতীয় সমাজ জাতি, বর্ণ ও নানা উপবর্গে বিভক্ত। সমাজের উচ্চবর্ণের মানুষরা নানা অধিকার ভোগ করলেও তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষরা বহুক্ষেত্রে তা থেকে বঞ্চিত। চণ্ডালদের অবস্থা শুদ্রদের চেয়েও শোচনীয়। জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গ্রাম ও শহরের বাইরে তাদের বাস করতে হত। কোল, ভিল, মুণ্ডা, খোদ প্রভৃতি অরণ্যচারী আদিম অধিবাসী থেকে শহরের আধুনিকতম মানুষ— সবই ভারতীয় জনসমাজের অন্তর্গত। পোশাক পরিচ্ছন, খাদ্যাভ্যাস ও অর্থনৈতিক অবস্থার দিক থেকে দেশবাসীর মধ্যে নানা পার্থক্য আছে। এইসব বৈচিত্র্যের কারণে ডঃ রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় ভারতকে বিভিন্ন ধর্ম, প্রথা, সংস্কৃতি, বিশ্বাস, ভাষা, জাতিগোষ্ঠী ও সামাজিক ব্যবস্থার যাদুঘর বলে অভিহিত করেছেন।
(৬) ভারতের অনৈক্য: ভারতের বিশাল আয়তন, সীমাহীন প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য-হেতু ভৌগোলিক প্রতিবন্ধকতা এবং জাতি-ধর্ম-ভাষার পার্থক্য প্রভৃতি কারণে ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে সমগ্র ভারতে কোনও রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয় নি। নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, মরুভূমি ও অরণ্যজনিত কারণে ভারত অসংখ্য জনপদ ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত ছিল। মৌর্য, গুপ্ত, খলজি ও মোগল আমলে অখণ্ড ভারত সাম্রাজ্য গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতা রাজনৈতিক বা বিদেশি আক্রমণের ফলে ভারতের রাষ্ট্রীয় ঐক্য বারংবার বাধাপ্রাপ্ত হয়। তাই বলা হয় যে, “ভারতের ইতিহাসের অনেকটাই হল এই দেশের সমগ্র বা বৃহৎ অংশকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি স্থায়ী সাম্রাজ্য গঠনের ব্যর্থ চেষ্টার কাহিনি মাত্র।” এই কারণে প্রাচীন বা মধ্যযুগে ভারত একটি ঐক্যবদ্ধ দেশ এবং ভারতীয়রা একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত হতে পারে নি।
ঐক্যের আদর্শ : সূচনা: এই বিপুল বৈচিত্র্যের অন্তরালে একটি ঐক্যের স্রোত যুগ যুগ ধরে ভারতীয় জীবনে প্রবাহিত। সাধারণ কোনও পর্যবেক্ষকের পক্ষে ভারতীয় জীবনের বহুত্বের মধ্যে এক, সমষ্টির মধ্যে ব্যক্তি এবং সংমিশ্রিতের মধ্যে মৌলিককে আবিষ্কার করা সম্ভব নয়। ঐক্য ও সমন্বয়ই হল ভারতীয় জীবনের মূল সুর। ডঃ স্মিথ ভারতবাসীর এই সমন্বয়ের আদর্শকে বৈচিত্রোর মধ্যে ঐক্য' বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন যে, সন্দেহাতীতভাবে ভারতে একটি মূলগত ঐক্য বিদ্যমান। এই ঐক্য ভৌগোলিক একত্ব ও রাজনৈতিক একতা অপেক্ষাও বহু গভীর ও অন্তরতর। রক্ত, বর্ণ, ভাষা, পোশাক, রীতি-নীতি ও সম্প্রদায়গত অসংখ্য বিভেদ অতিক্রম করে এই ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।" বাঙালি কবি অতুলপ্রসাদ সেন-এর কবিতায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এই আদর্শ :
"নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান,
বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান।"
(১) 'ভারতবর্ষ" নাম:- পর্বতমালা ও সমুদ্র দ্বারা পরিবেষ্টিত ভারতবর্ধ পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি নির্দিষ্ট সীমারেখাযুক্ত ভৌগোলিক অবস্ততা অর্জন করেছে। সুপ্রাচীন অতীত থেকেই হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এই ভূ-ভাগ ভারতবর্ষ নামে পরিচিত। রামায়ণ, মহাভারত, মনুসংহিতা ও বিষ্ণুপুরাণের বিভিন্ন শ্লোকে অখণ্ড ভারতবর্ষের ধারণা পরিলক্ষিত হয়। বিষ্ণুপুরাণের একটি শ্লোকে বলা হয়েছে যে, সমুদ্রের উত্তরে ও হিমালয়ের দক্ষিণে অবস্থিত দেশটির নাম ভারতবর্ষ এবং এখানে রাজা ভরতের বংশধর 'ভারত-সন্ততি' বা 'ভারত-সন্তান-গণ বসবাস করেন। প্রাচীন কবি, সাহিত্যিক ও দার্শনিকদের রচনায় 'আসমুদ্রহিমাচল সহজ যোজন বিস্তৃত' বা 'হিমবৎ-সেতু-পর্যস্তম', 'দেবনির্মিতম্ দেশম্' ভারতবর্ষের বর্ণনা আছে।
India offers umity in diversity." The Oxford History of India. V. A. Smith, P. 5. "India beyond all doubt possesses a deep fundamental unity, for more profound than that produced either by geographical isolation or by political suzerainty. That unity transcends the innumerable diversities of blood, colour, language, dress. manners and sect."-do, P. 7.
[India is a museum of cults and customs, faiths and tongues, racial types and social systems" The Fundamental Unity of Indian Dr. Radhaikumud Mookherji, ]
["From the human point of view India has been often described as an ethnological museum, in which numberless races of mankind may be studied. ranging from savages of low degree to polished philosophers."-The Oxford History of India, Smith, ]
0 Comments