উঃ- ভারতের প্রাকৃতিক পরিবেশ (Physical Featuresof India) 

  •  এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত ভারতবর্ষ হল ত্রিভূজাকৃতি একটি বিশাল উপদ্বীপ । উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিমে সুবিশাল পর্বতশ্রেণি এবং অপর তিনদিকে সমুদ্র দ্বারা মহাদেশ ভারতবর্ষ  একটি পরিবেষ্টিত ভারত এশিয়া মহাদেশের অন্যান্য দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন । অবিভক্ত ভারতের ভৌগোলিক সীমানা পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রায় ২,৫০০ মাইল এবং উত্তর থেকে দক্ষিণে ২,০০০ মাইল বিস্তৃত এর মোট আয়তন হল ১,৮০০,০০০ বর্গ মাইল। এই বিশাল ভূখণ্ডের সীমারেখার মোট ৬০০০ মাইল পর্বত দ্বারা এবং ৫০০০ মাইল সমুদ্র দ্বারা পরিবেষ্টিত । বিশালতা ও প্রাকৃতিক বৈচিত্রে ভারত এক অসাধারণ দেশ । ইউরোপ থেকে রাশিয়াকে বাদ দিলে বা ব্রিটেনকে কুড়ি গুণ করলে যে আয়তন হয় অবিভক্ত ভারতবর্ষ আয়তনে তার চেয়েও বড়ো । ভারতের ভূ-প্রকৃতিও মহাদেশের মতোই বৈচিত্র্যময়। মাউন্ট এভারেস্টের মতো সর্বোচ্চ গিরিশৃঙ্গ, চেরাপুঞ্জির মতো সর্বোচ্চ বারিপাতযুক্ত অঞ্চল, রাজস্থানের মতো সুবিশাল মরুভূমি ও বৃষ্টিপাতহীন এলাকা, দণ্ডকারণ্যের মতো গহন অরণ্য এবং সিন্ধু-গঙ্গা বিধৌত অঞ্চলের মতো উর্বর সমভূমি - সবই ভারতে বিদ্যমান । ভারতের মাটিতে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক পরিবেশ, বিভিন্ন প্রকার জলবায়ু, নানা ধরনের লতা-গুল্ম এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও ভাষার অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। মহাদেশ-সুলভ এই বিশালতা, প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব লক্ষ করে পণ্ডিতেরা ভারতবর্ষকে ক্ষুদ্রাকৃতি মহাদেশ' বা 'উপমহাদেশ' আখ্যা দিয়েছেন।
  • প্রাচীন সাহিত্যে ভারতবর্ষের পাঁচটি পৃথক বিভাগের উল্লেখ আছে। (১) উত্তরাপথ বা উদীচ্য অর্থাৎ উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারত। (২) মধ্যদেশ অর্থাৎ সরস্বতী নদীর প্রাচীন সাহিত্যে ভারতের ভৌগোলিক বিভাজন অববাহিকা অঞ্চল থেকে শুরু করে রাজমহল পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত গাঙ্গেয় সমতলভূমি। এই অঞ্চলের মধ্য দিয়েই গঙ্গা ও যমুনা দুটি প্রধান নদী প্রবাহিত। এই অঞ্চলই প্রাচীন কাল থেকে আর্যাবর্ত নামে পরিচিত। (৩) প্রতীচ্য বা অপরাস্ত অর্থাৎ পশ্চিম ভারত। রাজপুতানা, গুজরাট প্রভৃতি এলাকা এই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। (৪) প্রাচ্য বা পূর্বদেশ বা পূর্ব ভারত। ‘মধ্যদেশ' বা 'আর্যাবর্তের পূর্বে বাংলা, বিহার এই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। (৫) দক্ষিণাপথ, দাক্ষিণাত্য বা দক্ষিণ ভারত-এর অবস্থান হল মধ্যদেশের দক্ষিণে।
  • উপরিউক্ত বিভাজন ব্যতীত পুরাণে ভারতবর্ষকে দু'ভাগে ভাগ করা হয়েছে। আর্যাবর্ত ও দাক্ষিণাত্য (১) আর্যাবর্ত অর্থাৎ উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে নর্মদা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ভূ-ভাগ। (২) দাক্ষিণাত্য অর্থাৎ তাপ্তি ও কৃষ্ণা নদীর মধ্যবর্তী  অঞ্চল। ডা ভিনসেন্ট আর্থার স্মিথ (Dr. V. A. Smith) ও অন্যান্য পণ্ডিতেরা এর সঙ্গে আরেকটি বিভাগ যোগ করেছেন— সুদূর দক্ষিণ অর্থাৎ তুঙ্গভদ্রা নদী থেকে কুমারিকা অন্তরীপ পর্যন্ত অঞ্চল। আধুনিক ভৌগোলিকরা ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে বিচার করে ভারতকে পাঁচভাগে বিভক্ত করেছেন। রাজনৈতিক ইতিহাসের দিক থেকে এই আধুনিক ভূ-প্রাকৃতিক বিভাগই যুক্তিযুক্ত। এই বিভাগগুলি হল : (১) উত্তরের পার্বত্য বিভাগ অঞ্চল, (২) সিন্ধু-গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা, (৩) মধ্য ভারতের মালভূমি, (৪) দক্ষিণ ভারতের মালভূমি এবং (৫) সুদূর দক্ষিণ।
■ (১) উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল : ভারতের উত্তর-পশ্চিম, উত্তর ও উত্তর-পূর্বে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতমালা হিমালয় বিশাল রক্ষাপ্রাচীরের মতো দণ্ডায়মান। ভারতের উত্তর- পশ্চিমে অবস্থিত পামীর মালভূমি থেকে উত্থিত হয়ে ২,৫৬০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ৩২০ কিলোমিটার প্রস্থবিশিষ্ট হিমালয় পর্বতমালা ক্রমশ অর্ধ-চন্দ্রাকারে উত্তর থেকে পূর্বদিকে চলে গেছে। হিমালয় পর্বতমালা দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মতো ভারতবর্ষকে চীন, তিব্বত ও ব্রহ্মদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। আবার অন্যদিকে সুলেমান ও হিন্দুকুশ পর্বতমালা ভারতকে রাশিয়া, ইরান ও বেলুচিস্তান থেকে পৃথক করেছে। সুবিশাল ও দুর্লঙ্ঘ্য এই পর্বতমালার বুকেই আছে খাইবার, বোলান, গোমাল, বানিহাল, কুরাম, তোচি প্রভৃতি গিরিপথ। এই সব গিরিপথ ধরেই পারসিক, গ্রিক, কুষাণ, শক, হুন, পঙ্গুর, তুর্কি, আফগান ও মোঙ্গলরা যুগ যুগ ধরে ভারতভূমির উপর আক্রমণ হেনেছে। এই পার্বত্য অঞ্চলের বুকেই কাশ্মীর, নেপাল, সিকিম, ভুটান প্রভৃতি স্থানগুলি অবস্থিত। পর্বতসঙ্কুল অঞ্চলে যোগাযোগের অসুবিধার কারণে ভারতের সমতলভূমির রাজনৈতিক ঝড়-ঝঞ্ঝা এই অঞ্চলকে কোনওভাবেই প্রভাবিত করতে পারে নি।

■ (২) সিন্ধু-গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা : হিমালয়ের পাদদেশের দক্ষিণ থেকে শুরু করে মধ্য ভারতের মালভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলটি সিন্ধু-গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা নামে পরিচিত। সিন্ধু, রাজপুতানা, অবিভক্ত পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, উত্তর বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও বাংলাদেশের বিশাল এলাকা নিয়ে এই অঞ্চল গঠিত। এই অঞ্চলটি উত্তর ভারতের সমভূমি নামেও পরিচিত। সমগ্র এলাকাটি পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ২৫০০ কিলোমিটার এবং উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ২৪০ থেকে ৩২০ কিলোমিটার বিস্তৃত। এই অঞ্চলের উপর দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে সিন্ধু, গঙ্গা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ও তাদের অসংখ্য শাখা-প্রশাখা। নদী-বিধৌত এই অঞ্চলটি খুবই উর্বর এবং প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ। নদীপথে যোগাযোগের সুবিধা থাকায় বাণিজ্যিক দিক থেকেও এই অঞ্চলটি খুবই সমৃদ্ধশালী। এই অঞ্চলের নদী-তীরবর্তী স্থানগুলিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে প্রাচীন ভারতের বহু বিখ্যাত নগর, বন্দর ও সাম্রাজ্য। এই অঞ্চলের সম্পদের লোভেই স্মরণাতীত কাল থেকে বিদেশি আক্রমণকারীরা বারংবার ভারতের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এই অঞ্চলেই সংঘটিত হয়েছে আর্য সভ্যতার বিকাশ, ধর্মীয় আন্দোলন এবং ভারত ইতিহাসের যুগান্তকারী বিভিন্ন যুদ্ধসমূহ। বহু সাম্রাজ্য ও সভ্যতার উত্থান ও পতনের পীঠভূমি হল এই অঞ্চল।

■ (৩) মধ্য ভারতের মালভূমি : সিন্ধু-গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে বিদ্ধা পর্বতের পাদদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা মধ্য ভারতের মালভূমি নামে পরিচিত। বিন্ধ্য পর্বতমালা উত্তর ভারতকে দাক্ষিণাত্য থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। 

এই অঞ্চলের গহন অরণ্য ও পার্বত্য অঞ্চল ভারতের আদিম অধিবাসীকোল, ভীল, মুণ্ডা, সাঁওতাল প্রভৃতি আদিবাসীদের বাসস্থান। ছোটোনাগপুর, সাঁওতাল পরগণা প্রভৃতি স্থান এই অঞ্চলেই অবস্থিত।

■ (৪) দক্ষিণ ভারতের মালভূমি : বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণ থেকে কৃষ্ণা-তুঙ্গভদ্রা নদীর উত্তরের ভূ-ভাগ পর্যন্ত অঞ্চল দক্ষিণ ভারতের মালভূমি নামে পরিচিত। মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, অস্ত্র প্রভৃতি রাজ্য এবং পশ্চিমঘাট পর্বতমালা এই মালভূমির অন্তর্ভুক্ত। প্রাচীন যুগে এই অঞ্চলে রাষ্ট্রকুট, চালুক্য প্রভৃতি শক্তিশালী রাজ্যের উদ্ভব হয়। বিন্ধ্য পর্বত উত্তরের আক্রমণকারীদের হাত থেকে দাক্ষিণাত্যকে দীর্ঘদিন রক্ষা করেছে। মৌর্য ও গুপ্তরা এই অঞ্চলের উপর আধিপত্য স্থাপন করলেও তা স্থায়ী হয় নি। আলাউদ্দিন খলজি এই স্থান দখল করেছিলেন। মহম্মদ-বিন-তুঘলকের আমলে সুলতানি শাসনকে উপেক্ষা করে এখানে বিজয়নগর ও বাহমনি রাজ্যের উৎপত্তি ঘটে। এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্গমতার জ শিবাজির পক্ষে ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে সফলতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল।

■ (৫) সুদূর দক্ষিণ  :  দাক্ষিণাত্যের মালভূমির দক্ষিণে অবস্থিত সমগ্র অঞ্চলটিই 'সুদুর দক্ষিণ" নামে পরিচিত। কৃষ্ণা-তুঙ্গভদ্রা নদীর দক্ষিণ থেকে ভারত মহাসাগরের উপকূল পর্যন্ত এই অঞ্চলটি বিস্তৃত। উর্বর ও শস্য-শ্যামল এই অঞ্চলে উৎপন্না হত মশলা, চন্দনকাঠ, অগুরু, গজদত্ত, মুক্তা প্রভৃতি মূল্যবান সামগ্রী। সমুদ্র উপকূলবর্তী এই অঞ্চলের অধিবাসীরা স্বাভাবিকভাবেই নৌবিদ্যায় পারদর্শী হওয়ায় প্রাচীনকাল থেকেই শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে এই অঞ্চলের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কাবেরিপত্তনম ও কোচিন ছিল এই অঞ্চলের বিখ্যাত বন্দর। প্রাচীনকালে এই অঞ্চলে চোল, চের, পাণ্ড্য, কেরল প্রভৃতি রাজ্যগুলি গড়ে ওঠে। উত্তর ভারত থেকে বহু দূরে অবস্থিত হওয়ার উত্তর ভারতের রাজন্যবর্গের পক্ষে এই অঞ্চলে স্থায়ী কোনও সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় নি। এর ফলে এই স্থানটি হয়ে ওঠে তামিল সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র।





( ভারতের ইতিহাস : ভৌগোলিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট )