উঃ:- ভারতের জনগোষ্ঠী (The Races in India) : ভারতবর্ষ এক সুবিশাল এবং অতি প্রাচীন দেশ। সুদূর অতীতে ভারতে নব্যপ্রস্তর যুগ (New Stone Age) এবং তাম্রপ্রস্তর যুগের (Chaleolithic Age) মানুষরা কোন "মুতাত্ত্বিক যাদুঘর" জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিল তা বলা কঠিন, তবে তাদের অধিকাংশের দেহেই যে দ্রাবিড় জাতির রক্ত প্রবাহিত ছিল, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এরপর ভারতে আসে আর্য, পারসিক, গ্রিক, পহ্লব, শক, কুষাণ, হূন প্রভৃতি জাতির মানুষ। তারপর একে একে আসে আরব, তুর্কি, আফগান, মোঙ্গল, পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসি, ইংরেজ এবং আরও বিভিন্ন জাতির মানুষ। এইভাবে যুগ যুগ ধরে বহু বিদেশি জাতি ও উপজাতি ভারতে এসে ভারতীয় জনসমুদ্রে মিশে গিয়ে "ভারতীয় মহাজাতি গঠন করেছে। তাই ভারতের জনগোষ্ঠীতে আজ আলাদা করে কোনও জাতিগোষ্ঠীর সন্ধান পাওয়া দুরূহ। ডঃ ভিনসেন্ট স্মিথ তাই ভারতকে 'নৃতাত্ত্বিক যাদুঘর ('ethnological museum) বলে অভিহিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতকে বলেছেন "মহামানবের সাগর ।
নৃতাত্ত্বিকরা মানুষের মাথার খুলি, চোয়াল ও বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গড়ন, দেহের উচ্চতা, গায়ের রঙ, চুল, ভাষা প্রভৃতি বিচার করে ভারতীয় জনগোষ্ঠীকে কয়েকটি ভাগে বিভিন্ন গোষ্ঠী (Herbert Risley), ডঃ জে. এইচ. হাউন (Dr. J. H. Hutton) এবং ডঃ বিরজাশঙ্কর গুহ (Dr. B. S. Guha)-র নাম উল্লেখযোগ্য। এইসব পণ্ডিতরা নানাভাবে ভারতীয় জাতিগোষ্ঠীকে বিভক্ত করলেও ডঃ বিরজাশঙ্কর গুহ-র বিভাজনটিই বর্তমানে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য। ডঃ ওহ ভারতীয় জন প্রবাহকে ছয়টি স্বতন্ত্র গোষ্ঠীতে বিভক্ত ভারতের ইতিহাস : ভৌগোলিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট করেছেন। সেগুলি হল- (১) নেগ্রিটো (Negrito), (২) আদি অস্ট্রেলিয় (Proto- Australoid), (৩) মোঙ্গলী (Mongoloid) (8) ভূমধ্যসাগরীয় (Mediterranean), (৫) পাশ্চাত্য গোলমুখ (Western Brachycephals) এবং (৬) নর্ডিক (Nordic )
(১) নেগ্রিটো : আফ্রিকার নিগ্রো জাতি থেকে উদ্ভূত নেগ্রিটো গোষ্ঠীর মানুষরা ভারতে প্রায় অবলুপ্ত। আন্দামান-নিকোবর, কোচিন, ত্রিবাঙ্কুর, বিহারের রাজমহল অঞ্চল এবং আসামের অঙ্গামি নাগাদের মধ্যে এদের কিছু কিছু অস্তিত্ব এখনও দেখা যায়। এরা সর্বাকৃতি ও কৃষ্ণবর্ণ--এদের নাক চ্যাপ্টা, ঠোঁট পুরু এবং মাথার চুল কোঁকড়ানো।(২) আদি অস্ট্রেলিয় : অস্ট্রেলিয়ার আদি মানবদের সঙ্গে এই গোষ্ঠীর মিল আছে। ভারতের কোল, ভিল, মুণ্ডা, ভূমিজ, সাঁওতাল প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর মানুষরা এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এদের গাত্রবর্ণ কৃষ্ণ, চুল তামাটে, কপাল চওড়া এবং নাক লম্বা। আদি-অস্ট্রেলিয় প্রভাবেই হয়তো এদের আকৃতি এ ধরনের।
(৩) মোঙ্গলীয় : এই গোষ্ঠী সম্ভবত মধ্য এশিয়া থেকে ভারতে এসেছিল। এদের গায়ের রঙ পীতাভ, নাক চ্যাপ্টা, মুখমণ্ডল ও দেহ লোমহীন। সিকিম, ভুটান, নেপাল, আসাম, ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চলে এইসব মানুষদের বসবাস।
(৪) ভূমধ্যসাগরীয় : এই জনগোষ্ঠীর আদি বাসস্থান ভূম্যসাগরীয় অঞ্চলে। কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরল, পাঞ্জাব, সিন্ধু, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে এদের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। সাধারণভাবে এদেরই দ্রাবিড়ভাষী বলা হয়। এদের দেহের গড়ন ও গাত্রবর্ণ মাঝারি।
(৫) পাশ্চাত্য গোলমুণ্ড : ওয়েস্টার্ন ব্রাকিসিফেলস্ বা পাশ্চাত্য গোলমুখ- গোষ্ঠীর আদি নিবাস সম্ভবত পামীর মালভূমি, তাকলামাকান মরুভূমি, আল্পস পর্বত ও পূর্ব ইউরোপ। বাংলা, বিহার, ওড়িশা, গুজরাট, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ প্রভৃতি অঞ্চলে এই গোষ্ঠীর মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়।
(৬) নর্ডিক: এই গোষ্ঠীর মানুষরা দীর্ঘকায়, রক্তাভ গৌরবর্ণ ও উন্নত নাসিকা-যুক্ত। তাদের চুলের রঙ বাদামি থেকে ঘোরতর কালো। এরাই বৈদিক আর্য সভ্যতার স্রষ্টা। উত্তর- পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি অঞ্চলে এই জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের দেখা যায়।
এইসব বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে ভারতীয় মহাজাতি। এই মিশ্রণের ফলে কোনও গোষ্ঠীই নিজ বৈশিষ্ট্য বা স্বাত্য বজায় রাখতে পারে নি। সব জাতিগোষ্ঠী মিলে-মিশে একাকার হয়ে গেছে। ভারতে গড়ে উঠেছে এক মিশ্র সংস্কৃতি'।
0 Comments