উত্তর:- শরৎচন্দ্রের লেখা ‘পল্লীসমাজ' উপন্যাসে রমা চরিত্রটি খুব আকর্ষণীয়। রমা রমেশকে ভালোবাসে কিন্তু তাকে সামাজিক দ্বন্দ্বের জন্য বিয়ে করতে পারেনি। কিন্তু রমা অদৃষ্টের জন্যই কিছু সময়ের মধ্যে বিধবা হয়ে যান। এই বিধবানারীর ভালোবাসা অন্তরের বেদনা ও গভীর প্রেম নিয়ে রমা স্বার্থকভাবে উপন্যাসে আত্মপ্রকাশ করেছে। রমা রমেশের সম্পর্ক সামাজিক কারণে বিকর্ষণের দ্বন্দ্বে বিক্ষুব্ধ। রমা পল্লীসমাজের মেয়ে, তাই তার মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই জটিলতা আছে। ভাগ্যের কারণে বিধবা জীবনের বেদনায় বিগলিত রমা অতিগোপনের সঙ্গে তার ভালোবাসা পালন করেছে। ঘটনার ক্রম অনুযায়ী দেখা যায় যে, বাঁধ কেটে দিয়ে তাদের যে লোকসান হবে তা ক্ষতিপূরণের জন্য রমেশের কাছে দাবি করেছে। ফলে তার মধ্যে দুটি সত্তার প্রকাশ ঘটেছে। একদিকে সে জমিদার, অন্যদিকে সে কঠোর নিষ্ঠুর, আবার অন্যদিকে সে এক চিরন্তনি নারী। তাই রমেশের ক্ষতি হবে সে কামনা করে না। সে রমেশের বিরুদ্ধে লাঠিয়াল পাঠায় তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য। কিন্তু আসলে তা নয়। সে রমেশকে ভালোবাসে তাই তার বীরত্বের জন্য এই রূপ কাজ করে।

   রমেশ সমাজের নানারকম কার্যকপালে যুক্ত থাকায় রমেশের নামে নালিশ করে বেণী ঘোষাল। রমা তাকে সমর্থন জানায়। বেণী ঘোষাল আকবরকে রমেশের নালিশের প্রস্তাব দিলে সে রাজি হয় না। কারণ, রমেশ সমাজসংস্কারের কাজ করে। যার জন্য এই নালিশে আকবরের রাজি না হওয়ায় বুকের ওপর থেকে পাষানের ভার নেমে গিয়েছিল। আসলে রমাকে বৈধবজীবনের পর যখন পিতৃগৃহে আসতে হয়, তখন পরিবেশ পরিস্থিতি সামাজিক চাপে পড়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধেও অনেক কাজ করতে হয়। এতে রমার চরিত্রের মধ্যেও একটি দ্বন্দ্বও দেখা যায়। এর মধ্যে একদিকে সমাজ সংস্কার, অন্যদিকে রমা ও রমেশের প্রেম - এই দুয়ের মাঝে তার হৃদয় চিত্তে দ্বন্দ্ব গভীর ও জটিল হয়ে ওঠে। রমা এক হিন্দু বিধবা নারী। সমাজসংস্কারে বিশ্বাসী তাই গ্রাম্য পরিবেশে গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনসংস্কারকে সে উপেক্ষা করতে পারেনি। রমেশের মতো সে বিদেশে উচ্চশিক্ষায় লালিত হয়নি। তাকেই থাকতে হয়েছে গ্রামে। তাই তার মনের ভিতরে স্বাধীনতার ইচ্ছা থাকলেও। সেটাকে গ্রহণ করার কোনো উপায় নেই। সমাজের গ্রাম্য বিরোহের আচার আচরণ তাকে ঘিরে রেখেছে।

   উপন্যাসে চরিত্রে দেখা গিয়েছে রমা নিজেকে রমেশের কাছ থেকে বিদায় নিতে চেয়েছে। রমার এইরূপ আচরণে লেখক পরিণত শিল্পবোধের পরিচয় দিয়েছেন। রোগসজ্জায় শায়িত বিশ্বেশ্বরীর কাছে রমা হ্রদয় উন্মুক্ত করে তার অন্তরে চাপা ভালোবাসা প্রেমের স্বীকার উক্তি দিয়েছে। তাই যখন বিশ্বেশ্বরী দেবী সুস্থ হয় তখন রমা সংসার ত্যাগ করে তার সঙ্গে কাশি চলে যান। খুব স্বাবাভিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগতে পারে রমেশের প্রতি তার গভীর ভালোবাসা থাকলে রমেশকে স্বীকার না করে রমেশের সঙ্গো এক না হয়ে রমেশকে ছেড়ে চলে না গিয়ে কেন কুঁয়াপুরেই থেকে গেল । কি চিরবিচ্ছের সংগত ছিল। সেই কারণেই এরূপ মনোভাব। 615

   'পল্লীসমাজ' উপন্যাসটি বিংশ শতাব্দির প্রথম দিকে বাংলার পল্লীসমাজের নানা সংস্কার বিধি নিষেধ রীতি নিয়মকানুনের বেড়া জালে আবদ্ধ ছিল। এইরূপ দৃশ্য দেখানো হয়েছে। এইরূপ নানা কুসংস্কার বিধিনিষেধ বিধবানারী রমার চরিত্রে চিত্রিত হয়েছে। রমার মধ্যে যে হৃদয় অনুভূতি বাস্তি সত্ত্বা ফুটিয়ে তুলতে চাইলেও তৎকালীন সমাজ সংস্কারের গন্ডি পেরিয়ে তা করা সম্ভব ছিল না। এই প্রসঙ্গে শরৎচন্দ্র একটি মন্তব্য করেছেন - "সমাজের মধ্যে যাকে গৌরব দিতে পারা যায় না, তাকে কেবলমাত্র প্রেমের দ্বারা সুখি করা যায় না। মর্যাদাহীন প্রেমেরভার আলগা দিলেই দুর্বিসহ হইয়া উঠে। তাছাড়া শুধু নিজেদের কথা নয়, ভাবি সন্তানের কথাটা সবচেয়ে বড়ো কথা, তাহাদের ঘাড়ে অপরের বোঝা চাপাইয়া দেওয়ার ক্ষমতা অতি বড়ো প্রেমেরও নাই।" বেণী ছিল রমেশের বিপক্ষের লোক। তাই বেণী চেয়েছিল রমাকে দিয়ে রমেশকে জব্দ করতে। কিন্তু রমা রমেশের প্রতি আকর্ষণ থাকায় তা করতে সম্মতি দিল না। তখন বেণী তার ষড়যন্ত্র শুরু করল রমাকে অপবাদ দেওয়ার। যড়যন্ত্র করে রমাকে অপবাদও দিল। এর ফলে রমার কলঙ্ক গ্রামে রটে গিয়েছিল। রমাকে একঘরেও করে দিয়েছিল। একসময় যে রমা কুঁয়াপুর গ্রামের লোকের কাছে শ্রদ্ধার আসনে ছিল, তার পক্ষে গ্রাম্য সমাজের কলঙ্কভার বয়ে এক ঘরে হয়ে থাকা। রমেশের প্রতি রমার প্রেমের বেদনা ও রমেশের দুর্ভাগ্যের কারণে আত্মগ্লানী বহন করে গ্রামে বাস করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। অন্য সবকিছুর চাইতে সব চেয়ে বেশী অসহায় ছিল ভালোবাসার মানুষ রমেশের প্রতি তার অন্যায়ের তীব্র অনুশোচনা। এই জন্য বাকি জীবনটা কাশিতে গিয়ে বাস করা ছাড়া তার কোনো উপায় ছিল না। এই রকম পরিস্থিতিতে বলা যায়, রমার