ভূমিকা : মানুষ সামাজিক জীব। তাই সমাজকে বাদ দিয়ে কিংবা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে কোনো ব্যক্তি বা পরিবার বাঁচতে পারে না। রাষ্ট্র হলো রাজনৈতিকভাবে গঠিত সর্বোচ্চ সামাজিক প্রতিষ্ঠান। তাই রাষ্ট্র তার সমাজ থেকে অর্থাৎ অন্য রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিংবা এককভাবে টিকতে পারে না। ফলে সামাজিক নিয়মেই রাষ্ট্রকে অন্য অনেক রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হয়। বর্তমানে শুধু রাষ্ট্র নয়, অ-রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তার সঙ্গে সম্পর্কও সব দেশের কাছেই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সংজ্ঞা : পররাষ্ট্রনীতির সংজ্ঞায় বলা হয় " পররাষ্ট্রনীতি হলো দেশের বাইরের পরিবেশ সম্পর্কে একটি রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য, পরিকল্পনা এবং ক্রিয়াকলাপ চালর্স বার্টন বলেছেন— "একটি রাষ্ট্র বৈদেশিক ব্যাপারে যে সব কার্যকলাপ সম্পাদন করেছে এবং বৈদেশিক ক্ষেত্রে যা করতে চাইছে তার সমষ্টিকে বো যায়।” ফ্রাঙ্কল অনেকটা এই ধরনের সংজ্ঞা দিয়ে বলেছেন- বৈদেশিক নীতি, বলতে সেই সব সিদ্ধান্ত ও কার্যকলাপের সমষ্টিকে বোঝায়, যা একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে একাধিক রাষ্ট্রের সম্পর্কের সঙ্গে যুক্ত.।
নির্ধারক : মানুষের আচরণ যেমন তার পরিবেশ ও অবস্থার ওপর নির্ভর করে ঠিক তেমনি একটি দেশের বৈদেশিক নীতিও সেই দেশের ভৌগোলিক অবস্থা ও অবস্থান, অর্থনীতি, সামরিক শক্তি, ঐতিহাসিক ঐতিহ্য, রাজনৈতি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক মতাদর্শ ও মূল্যবোধের উপর নির্ভরশীল। অবশ্য বিশ রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক পরিবেশও বৈদেশিক নীতিকে প্রভাবিত করে। এইস অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক প্রভাবকেই বৈদেশিক নীতির নির্ধারক বলা হয়।
• ভৌগোলিক অবস্থান: একটি রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ সর্বাগ্রে বিবেচিত হয় তার ভৌগোলিক অবস্থান। কারণ এর উপরই নির্ভ করছে তার সুরক্ষা, সামরিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব। ভৌগোলিক অবস্থান বলছে অবশ্য কয়েকটি বিষয়কে বোঝায়। যেমন -
প্রথমত : তার আয়তন। রাষ্ট্রে আয়তন এমন হওয়া উচিত যা তার দেশের জনসাধারণের সঙ্গে সাম♚সাপ এবং জীবন ও জীবিকার পক্ষে উপযুক্ত।
দ্বিতীয়ত : জলবায়ু মোটামুটি ঠাণ্ডা কিংব নাতিশীতোয় হলে কায়িক পরিশ্রমের ক্ষেত্রে উপযুক্ত হয়। তৃতীয়ত : প্রাকৃতিক পরিবেশ, অর্থাৎ দেশটি যদি পাহাড়, পর্বত, নদী ও সমুদ্র দ্বারা বেষ্টিত হয় তাহলে প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সহায়ক হয় এবং বৈদেশিক আক্রমণের সম্ভাবনা বা থাকে। চতুর্থত : ভূপ্রকৃতি বলতে সাধারণত রাষ্ট্রের আকৃতির কথা বলা হয়। এটি যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়।
অর্থনৈতিক সম্পদ : প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত যে নির্ধারকারি বৈদেশিক নীতি প্রণয়নে সমান গুরুত্ব পেয়ে এসেছে তা হলো অর্থনৈতিক সম্পদ প্রকৃতপক্ষে একটি দেশের উন্নত অর্থনীতি এবং অপর্যাপ্ত অর্থনৈতিক সম্পদ তার বিদেশ নীতিকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। বর্তমানে অবশ্য অর্থনৈতিক সম্প বলতে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সম্পদকে বোঝায় না।
জনসংখ্যা : জনসংখ্যাকে বর্তমানে মানবসম্পদ বলা হয়। অর্থাৎ জনগ একটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় শক্তির মানদণ্ডরূপে পরিগণিত হয়। এই কারণেই দেশের জনগণের সংখ্যা বৈদেশিক নীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক। শুধু সেনা-সামন্ত নয়, সুশৃঙ্খল জাতীয়তাবাদী নাগরিক এবং সুশিক্ষিত রাজনৈতিক চেতনাসম্পা মানুষ সর্বদাই তার দেশের বিদেশনীতিকে প্রভাবিত করে।
কূটনীতি : বিদেশনীতির সঙ্গে কূটনীতির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্প রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বিদেশনীতির সাফল্য অনেক বেশি কূটনীতির উপর নির্ভর করে। সেই কারণে একটা দেশের কূটনৈতিক মান ও ব্যবস্থার উপর বিদেশনীতি প্রয়োগ অনেকটা নির্ভরশীল। মনে রাখতে হবে বিদেশনীতি প্রণয়ন করা হয় দেশের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণের জন্য।
রাজনৈতিক : এখানে রাজনৈতিক দক্ষতা বলতে সরকার সহ শাসক দল, বিরোধী দল, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক মতবাদ, মূল্যবোধ, জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব সবাইকে বোঝানো হয়েছে। কারণ একটি দেশের বৈদেশিক নীতি প্রণয়নে এই সকলের একটা সমবেত ভূমিকা থাকে। মূলত সরকার বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন করলেও গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি প্রসঙ্গে। দেশের রাজনৈতিক মতবাদ বিশেষ করে বিরোধী দলের সঙ্গে পরামর্শ করে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। উদাহরণ হিসেবে ইরাক যুদ্ধে এবং যুদ্ধের পরে মার্কিন চাপ ও অনুরোধ সত্ত্বেও অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের পরামর্শে ইরাকে সেনা প্রেরণ করেনি।
আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি : বিদেশনীতি প্রণয়নে সমকালীন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বা বিশ্বরাজনীতির ঘটনাপ্রবাহকে কখনোই অস্বীকার করা যায় না। যতই তত্ত্বগতভাবে বা অন্যান্য নির্ধারকের বিচারে বিদেশনীতি রচিত হোক না কেন, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির উপর তার প্রয়োগ যথেষ্ট পরিমাণে নির্ভর করে। যেমন উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগের পরিস্থিতি আর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরবর্তী পরিস্থিতি এক নয়।
মতাদর্শ : প্রকৃতপক্ষে একটা দেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শ বা মতবাদর্শই সেই দেশের বৈদেশিক নীতির প্রধান নির্ধারক হওয়া উচিত। যদিও তা হয় না তথাপি মতাদর্শ রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এই গুরুত্ব ঠান্ডা লড়াইয়ের যুগে প্রমাণিত হয়েছে। প্রত্যেক দেশেরই একটা নিজস্ব নির্দিষ্ট মতাদর্শ আছে। মতাদর্শকে ভিত্তি করেই প্রতিটি দেশ তার বৈদেশিক নীতি তৈরি করে। এক্ষেত্রে ভৌগোলিক অবস্থান, অভ্যন্তরীণ নীতি কিংবা সম্পদ একমাত্র নির্ধারকরূপে বিবেচিত হয় না।
0 Comments