নারী-পুরুষের বৈষম্যের প্রকৃতি আলোচনা ।
থাক্রমে নারী ও পুরুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্য। অন্যদিকে, সন্তান প্রতিপালন, রান্নাবান্নার দায়িত্ব এককভাবে নারীর উপর চাপিয়ে দেওয়া বা পরিবারের সদস্যদের আর্থিক ভরণপোষণের দায়িত্ব পুরুষের উপর অর্পণ হচ্ছে যথাক্রমে নারী ও পুরুষের জেন্ডার ভূমিকা।
প্রকৃতি : এ জেন্ডার কোন প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নয়। এটা সমাজ কর্তৃক নির্ধারিত বৈশিষ্ট্য। তাই সমাজ কর্তৃক নির্ধারিত জেন্ডার ভূমিকা অনেক সময় নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এই নির্ধারিত জেন্ডার ভূমিকার কারণেই সমাজ নারীকে যেমন বিমানের পাইলট হিসাবে দেখতে পছন্দ করে না, তেমনি রান্নাঘরে পুরুষের উপস্থিতিও সমাজ স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয় না ।
প্রচলিত জেন্ডার ধারণায় নারী হলো দুর্বল, কোমল, আবেগপ্রবণ, শান্ত ও নম্র। অপরদিকে পুরুষদের কঠোর, সবল, যুক্তিবাদী ইত্যাদি বলে বিবেচনা করা হয়। নারী-পুরুষ সম্পর্কে এসব স্টোরিওটাইপ ধ্যান-ধারনা তৈরির পিছনে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা যেমন দায়ী; তেমনি এর পিছনে ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবও জড়িত। চর্যাপদকে যদি বাঙলা সাহিত্যের প্রথম নির্দেশন হিসেবে ধরা হয়, তাহলে বাঙালি সংস্কৃতি তথা বাঙালি জাতির বয়স হাজার বছরের কম নয়। এই হাজার বছরের ইতিহাস খুঁজলে সমাজে কেবল নারীর অধঃস্তন অবস্থাই চোখে পড়ে। শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতি,
অর্থনীতির মাঠে নারীর অংশগ্রহণ থাকলেও সেটা পুরুষের তুলনায় অতি নগণ্য। নারীদের এই পিছিয়ে থাকার কারণ যে তাদের মেধাশক্তি বা যোগ্যতার অভাব ছিল সেটা কিন্তু মোটেই নয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আধুনিক যুগে নারীদের সফলতার চিত্র থেকে সহজেই সেটা বোঝা যায়। নারীর এই অধস্তনতার কারণ হিসেবে তাই পুরুষতান্ত্রিক ধর্মীয় ও আর্থসামাজিক কাঠামোকে দায়ী করা যায়। জায়গায় নানা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এসব বৈষম্যের কারণ খুঁজতে গেলে সেই পুরুবতান্ত্রিক মানসিকতা, রাষ্ট্রীয় বৈষম্যপূর্ণ আইন-কানুন, ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভূমিকার উপস্থিতিই দেখা যায়।
> লিঙ্গ বৈষম্যে ভারতের মাথা হেঁট :
‘ওয়াল্ড ইকোনমিক ফোরাম' বা ডাব্লিউ ই এফ-এর রিপোর্টে লিঙ্গ বৈষম্যের নিরিখে বিশ্বের ১৪২টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১১৪তম। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে ভারতের নারীরা ভয়াবহ বৈষম্যের শিকার হন। এই সূচক থেকে বোঝা যায়, তথাকথিত শিক্ষা, প্রযুক্তি, কারিগরি, অর্থনীতিতে আধুনিকতার জয়ধ্বজা ওড়ানো হলেও সমাজ মানসিকতায় ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ভারত নামক দেশটি বহু যুগ পেছনে পড়ে আছে। ভারতীয় সমাজে নারীরা এখনো অনাকাঙ্ক্ষিত ও অবাঞ্ছিত।
> কর্মক্ষেত্রে ও শিক্ষায় বৈষম্য :
রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের বিষয়টিতে ভারতের অবস্থান ভালো সূচকে ১৫তম অবস্থানে রয়েছে দেশটি। কিন্তু উপার্জন, শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র ও সন্তান জন্মদানের ব্যাপারে বৈষম্য ভয়াবহ। এসব ক্ষেত্রে সূচকে সবচেয়ে খারাপ ২০টি দেশের মধ্যে একটি ভারত। কর্মক্ষেত্রে একজন নারীতে পুরুষের তুলনায় ৩০০ মিনিট বেশি কাজ করতে হয় সেই তুলনায় বেতনের পরিমাণ নারীদের কম।
> কমেছে মেয়ে শিশু জন্মের হার :
নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ধর্ষণ ও নারী নির্যতনের বিরুদ্ধে প্রচার চালালেও নারী স্বাস্থ্যের বিষয়টি এড়িয়ে গেছে। বর্তমান সরকার অবশ্য বলেছে যে, আগামী দিনগুলিতে গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্য উন্নয়নে তারা নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করবে। পুরুষদের তুলনায় নারী জন্মের হারও অনেক কমেছে ভারতে। সেখানে প্রতিবছর ১,০০০ ছেলে শিশু জন্ম নেয়, সেখানে মেয়ে শিশু জন্ম নেয় ৯১৮ জন। জন্মের আগেই অনেক কন্যা শিশুকে ভ্রুণ অবস্থায় হত্যা করা হয়, যাতে তারা পৃথিবীর আলো দেখতেই না পারে। শৈশবে শিশুকন্যারা পরিবারের মধ্যে বেশি অবহেলিত। তাদের শিক্ষার সুযোগ কম। তেমনি অর্থনৈতিক কাজকর্মে বা কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণেও মহিলাদের জন্য হাজার প্রতিবন্ধকতা। একই কাজে যুক্ত পুরুষদের থেকে মহিলাদের মজুরি কম, অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও কম।
অর্থনীতির বিকাশ যত বেশি হচ্ছে, বিশ্বে ভারতের গুরুত্ব যত বাড়ছে, ততই লিঙ্গ বৈষম্য প্রসারিত হচ্ছে। রাজনীতিতে মহিলাদের ক্ষমতায়নের প্রশ্নে ভারতীয় মহিলাদের কিছুটা অগ্রগতি হলেও শিক্ষার সুযোগ প্রাপ্তিতে, স্বাস্থ্য ও আয়ুর প্রশ্নে এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ ও পাবার ক্ষেত্রে খুবই শোচনীয় অবস্থা। মহিলাদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান ১৩৪তম স্থানে। অথচ ২০০৬ সালে ছিল ১১০তম জায়গায়।
> সামাজিক ক্ষেত্রে :
মহিলাদের স্বাস্থ্য ও আয়ুর বিচারে ভারত এ মুহুর্তে ১৪১তম স্থানে। অর্থাৎ শেষ থেকে দ্বিতীয় । লিঙ্গ অসমতা বা নারীদের প্রতি বৈষম্যের ক্ষেত্রে ব্রিকস দেশগুলির মধ্যে সবেচেয়ে খারাপ অবস্থাও ভারতের। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে একমাত্র ভুটান ও পাকিস্তান ছাড়া বাকি সব দেশের অবস্থা ভারতের তুলনায় অনেক ভালো। যে কোনও ক্ষেত্রেই জীবনের বাস্তবতাকে আমাদের গ্রহণ করতেই হবে। বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে গেলেই বুঝতে পারা যায় ছেলেরা বাবা-মায়ের দেখাশোনা কতদূর করে। বরং অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মায়ের দেখাশোনা মেয়েরাই করছে। মেয়েদেরও ছেলেদের মতোই বেঁচে থাকার অধিকার, উন্নতির অধিকার, সুরক্ষার অধিকার এবং কোনও কিছুতে অংশগ্রহণের অধিকার রয়েছে। এসব অধিকার থেকে মেয়েদের বঞ্চিত করা মানেই লিঙ্গ বৈষম্য এবং দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রকে চিরস্থায়ী করা।
বহু যুগ ধরে মেয়েরা জীবনের যেসব ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার, তার মধ্যে শিক্ষা অন্যতম। আমরা আমাদের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর কথা ভুলে যাই। তিনি বলেছিলেন— “একজন পুরুষকে শিক্ষিত করা মানে একজন মানুষকে শিক্ষিত করা, কিন্তু একজন নারীকে শিক্ষিত করা মানে গোটা সমাজকে শিক্ষিত করা।”
কন্যাসন্তানকে যদি সুযোগ সুবিধা দিয়ে বড়ো করা হয়, খুব সহজেই তারা ভাল এবং মন্দ সম্পর্কে ধারণা করতে পারে এবং জীবন সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু আমরা মেয়েদের স্বাধীনতা দিতে ভয় পাই। এর একটাই সমাধান—আমাদের দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে যে, যেকোনও মানুষের মতোই শিশুকন্যারও মানবাধিকার রয়েছে। যদি মেয়েদের নিরাপত্তা এবং রক্ষণাবেক্ষণ জাতীয় সমস্যা হয়, তবে এটা মনে রাখা জরুরি যে মেয়েদের ক্ষমতায়ন না করাটা, তাদের দুর্বলতাকে বাড়ানোর সামিল রয়েছে। এই লিঙ্গ অনুপাত থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০০১ সালের থেকে অবস্থা উন্নতি হয়েছে। ২০০১ সালে ১০০০ পুরুষে মহিলার সংখ্যা ছিল ৯৩৩। দশকের পর দশক ধরে ভারতে পুরুষের তুলনায় মহিলার পরিমাণ কমেছে। কিন্তু গত দু'দশকে পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হয়েছে। গত পাঁচ দশকে প্রতি ১০০০ পুরুষে মহিলার সংখ্যা ৯৩০ থেকে শুরু করে বর্তমানে ৯৪০-এ পৌঁছেছে।
> তৃতীয় লিঙ্গ :
জেন্ডার বৈষম্যের আলোচনায় তৃতীয় লিঙ্গ বা ট্রান্সজেন্ডারদের বৈষম্যের কথা আদালাভাবে না বললেই নয়। আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের স্বীকার হয় এই ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ই। সমাজে এদেরকে ব্যাঙ্গ করে ‘হিজড়া' বলা হয়। এরা ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের পাশাপাশি আইনগত ও রাষ্ট্রীয়ভাবেও বৈষম্যের স্বীকার হয়। বিভিন্ন দেশে তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি না থাকায় এরা জাতীয় পরিচয়পত্র পাসপোর্ট তৈরি থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও সরকারী চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রেও বৈষম্যের স্বীকার হয় ।
মানব জাতির ইতিহাস সভ্যতার উত্থান ও পতনের ইতিহাস। সভ্যতার এই উত্থান-পতনের ইতিহাস রচনায় নারী-পুরুষ উভয়েরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। একটি আধুনিক, আদর্শ ও উন্নত সমাজ গঠনে নারী-পুরুষ তৃতীয় লিঙ্গ সবার ভূমিকাকে স্বীকার করে হাতে হাত রেখে কাজ করার বিকল্প নাই।
0 Comments