উত্তর
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'পল্লীসমাজ' উপন্যাসে সমাজের জমিদারের শোষণ ও সমাজপতিদের মতাদর্শের কাহিনি আলোচিত হয়েছে। আর আলোচিত হয়েছে শিক্ষিত রমেশের সঙ্গে কুরুচিসম্পন্ন সমাজপতিদের সংঘর্ষ। পল্লীগ্রামের দুঃখের কাহিনী ইত্যাদি। অপরদিকে রমা রমেশের প্রেম-ভালোবাসার বর্ণনা ও বর্ণিত হয়েছে। উপন্যাসটিতে পল্লীসমাজের চিত্র লক্ষ্য করা যায় ।উপন্যাসের অন্যতম লক্ষ্য হল কাহিনির মধ্য দিয়ে পারস্পরিক
মানবজীবনেকে শিল্পসম্মত রূপদান করা। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সাহায্যে উপন্যাসের প্লট নির্মাণ করেন। যে কোনো কাহিনির প্রধান কাজ হল-মানুষের অন্তরের আনন্দ, বেদনা, বাসনা, ভাবনা ইত্যাদির রহস্যময় ভাবনার বিকাশ। এই উপন্যাসে শরৎচন্দ্র রমার প্রতি রমেশের প্রেমের বিকাশ ঘটিয়ে বিচিত্র ভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। রমার রমেশের প্রতি যে গভীর অনুভূতি প্রবণপ্রেম ছিল, তা রমেশের প্রতি বিরুদ্ধতার মধ্যদিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। পল্লীসমাজ উপন্যাসের মধ্যদিয়ে উপন্যাস ও পল্লীর চিত্রের সংমিশ্রণ ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে বলেছেন – “পল্লীসমাজ উপন্যাসও নয় পল্লীর চিত্র ও - নয়, উভয়ের মিশ্রণ” তাছাড়া উপন্যাসে রমা-রমেশের জমিদারির বিষয় সম্পত্তি সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে।
প্রত্যেক কাহিনিতে চরিত্রের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন চরিত্র আচরণের মধ্যদিয়ে কাহিনি সম্পন্ন হয়। এই উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে সমকালীন পল্লীসমাজের দর্পণ। বিশ্বেশ্বরী আদর্শ মহিলা। কিন্তু তার পুত্র তার আদর্শে পরিণত হয়নি। তাই বিশ্বেশ্বরী রমেশকে আদর্শ ও কতব্য বুদ্ধিতে সচেতন করে তুলেছেন। তার নিজ পুত্র বেণীর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও, রমেশ পিতৃ শ্রাদ্ধের সমস্ত দায়িত্ব গ্রহণ করে। আবার যতীনের উপনয়নের সময় সে রমার বাড়িতে যায়। রমাও বিশ্বেশ্বরীর অপূর্ব আচরণ দেখতে পায়। তাই রমেশের প্রতি তার ভালোবাসা সে জানায় বিশ্বেশ্বরীকে। রমা বলে রমেশ গ্রামের উন্নতি করতে গিয়ে তাকে অনেক অপমান সহ্য করতে হয এসব রমা দেখতে পারবে না। তাই রমা বিশ্বেশ্বরীকে বলে সে কাশি চলে যাবে। গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার জন্য রমা রমেশকে বলে যান-“পরবর্তী কালে গ্রামকে রক্ষার জন্য সে তীর্থ যাত্রা যান অপদিকে বিশ্বেশ্বরী বলে কুঁয়াপুর গ্রামে মরলে তার পুত্র বেণীর হাতে মুখআগ্নি হবে। তাতে তার মুক্তি হবে না। তাই সেও রমার সঙ্গে কাশি চলে যাবে।” বিশ্বেশ্বরী রমেশের আদর্শ সম্পর্কে বলেছেন- “তিনি একদিকেরমেশকে এই নির্জীব ব্যাধিগ্রস্ত পল্লীসমাজের মাঝখানে দাঁড়াইয়া উভয়ের মধ্যে মধ্যস্থা করিতে রমেশের উচ্চভাব প্রধান আদর্শের সঙ্গে পল্লীজীবনের বাস্তব অবস্থার একটা সামঞ্জস্য সাধন করিতে চেষ্টা করিয়াছেন।” আলোচ্য উপন্যাসে বিশ্বেশ্বরী অসাধারণ চরিত্র। যে কোনো উপন্যাসের মূল কাহিনির সঙ্গে পারস্পারিকতা বজায় রেখে কাহিনির চরিত্র আবর্তিত হয়। রমেশ দীর্ঘদিন প্রবাসে ছিল তাই পল্লীর প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে তার কিছুই জানা ছিল না। পিতৃশ্রাদ্ধ উপলক্ষ্যে সে গ্রামে ফিরে আসে। গ্রামের মানুষকে নিমন্ত্রণ করে ক্ষেন্তিবামনি ও তার কন্যাকে কেন্দ্র করে যে ঝড় ওঠে। সেই ষড়যন্ত্রের নায়ক বেণী ঘোষালের এই ষড়যন্ত্রের কল্পনা বুঝতে পারে। রমা রমেশকে সামাজিক দিক থেকে বিরোধিতা করলেও সে রমেশকে গভীরভাবে পেতে চায়। রমার এই আচারণে কোনরূপ কৃত্রিমতা নেই। তাই বলা হয়েছে উপন্যাসের ঘটনা বিন্যাস ত্রুটিবিহীন।
গ্রামের মানুষের উন্নতি করতে গিয়ে রমেশকে অনেক বাধা পেতে হয়েছে। ভালো মন নিয়ে গ্রামের লোককে কিছু দান করতে গেলে সন্দেহের চোখে দেখে। আবার বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে যখন রমেশ গ্রামের লোকেদের সমস্যা সমাধান করে। তখন তার সঙ্গে দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। তাই গ্রামের মানুষের এইরূপ আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে সে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু জ্যাঠাইমা তাকে বোঝায় ক্রুদ্ধ হলে হবে না। তার গ্রাম আর গ্রামের মানুষের অশিক্ষিত তাই তারা বোঝে না ।
. উপন্যাসের প্রত্যেকটি চরিত্র একে অন্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চলেছে। প্রতিটি চরিত্রই সমাজে থাকলেও তা পরিস্থিতির মুহূর্তে বেরিয়ে আসে। তৎকালীন গ্রামবাংলার শোচনীয়, দারিদ্র ও অত্যাচারিত এই উপন্যাসে আলোচিত হয়েছে। পল্লীসমাজের সংগ্রামে রমেশ জয়ী হয়েছে। কিন্তু রমা জমিদারি পক্ষ থেকে কাজ করায় তার পরাজয় হয়েছে। তাই সমগ্র উপন্যাসটি আলোচনার মাধ্যমে বোঝা যায় যে পল্লীসমাজ যথার্থ উপন্যাস।
0 Comments