উত্তর:- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘পল্লীসমাজ' উপন্যাসে অপ্রধান চরিত্রগুলির আলোচনা করা হয়েছে। তাঁর প্রধান লক্ষ্যই ছিল চরিত্র সৃষ্টি। উপন্যাস রচনায় চরিত্রের ভূমিকা যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা বলাই বাহুল্য। উপন্যাসের রচনায় চরিত্র প্রধান হোক আর অপ্রধানই হোক, চরিত্রের মধ্যেদিয়ে গল্পের রূপ পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। অপ্রধান চরিত্রগুলি হল গোবিন্দ গাঙ্গুলী, ধর্মদাস চাটুর্য্যে, দীনু ভট্টাচার্য, গৌরব আচার্য, আকবর, এছাড়াও পরাণ হালদার, বনমালী পাড়ুই, ক্ষেত্তি বামনি, রমার মাসি প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
গোবিন্দ গাঙ্গুলি : গোবিন্দ ছিল বেণী ঘোষালের চামচে। সে বেণী ঘোষালের কুকর্মের হাতিয়ার। গোবিন্দ গাঙ্গুলীর চরিত্রের মধ্যে দিয়ে বাস্তব জীবনের রূপটি তুলে ধরেছেন। গোবিন্দ গাঙ্গুলী স্বার্থপর, মিথ্যাবাদী, নীচ মনের মানুষ ছিল। গোবিন্দর অপমানবোধ এবং শালীনতা বোধ বলে কিছুই নেই। গ্রামের মানুষদের অবনতিতে গোবিন্দের ভূমিকা অনসীকার্য। যেমন, রমেশের বিরুদ্ধে যারা অপকর্ম করেছে তাদের এবং মিথ্যে মামলার সাক্ষী জোগার করা গ্রামের চাষিদের ওপর জোর করে সুদ আদায় করা, গ্রামের দরিদ্র মানুষদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, এসব কিছু কাজে এগিয়ে আসে গোবিন্দ গাঙ্গুলি।
দীনু ভট্টাচার্য : দীনু ভট্টাচার্য জাতিতে ব্রাক্ষণ । তৎকালীন সমাজ ব্রাক্ষণদের প্রাধান্য ছিল। কিন্তু দীনু ভট্টাচার্য অত্যাচারিত ব্যক্তি নন। গ্রামের অন্যান্য
সমাজপতির মতো নয় তিনি। তাঁর মধ্যে রেষারেষি ঝগড়া, মারামারি, জাত-পাতের ভেদাভেদ এরূপ মানসিকতা তার মধ্যে ছিলা না। তারিণী ঘোষালের ছেলে রমেশের বিরুদ্ধে গ্রামের জমিদাররা ষড়যন্ত্র করে। গোবিন্দ গাঙ্গুলীর ধর্মদাস প্রমুখেরা। কিন্তু দীনু ভট্টাচার্য যখন বোঝে তারা ষড়যন্ত্র করছে তখন সেখান থেকে সে সরে আসে। দীনু ভট্টাচার্য মনুষত্বের এক প্রদীপ স্বরূপ। তৎকালীন পল্লীসমাজের অভিজাত সম্প্রদায়ের রূপটিও দেখানো হয়েছে। শরৎচন্দ্রের এই উপন্যাসে দীনু চরিত্রটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। ১
ধর্মদাস চাটুর্য্যে : ধর্মদাস চাটুৰ্য্য ছিল বেণী ঘোষালের সহযোগী। ধর্মদাস নিজেকে ধর্মের দাস বলে অভিহিত করেছে। রমেশ তার পিতার মৃত্যুতে শোকাহত । ধর্মদাস নিজেকে ধর্মের দাস বলে অভিহিত করেছে। ধর্মদাস বেণী ঘোষালের মতই। শরৎচন্দ্র তার উপন্যাসে ধর্মদাস সমন্ধে বলেন- “তাঁহার কাঁধে মলিন উত্তরীয় নাকের উপর একজোড়া ভাটার মতো মস্ত চশমা- পিছনে দড়ি দিয়ে বাঁধা, সাদা চুল, সাদা গোঁফ, তামাকের ধোঁয়ায় তাম্রবর্ণ। গ্রামীণ সমাজের নানা আচার-ব্যবহার, সংকীর্ণতা, শরৎচন্দ্র তুলে ধরেছেন।” আর গ্রামের নিম্ন পরিণতি দেখে রমেশ যখন গ্রাম ছেড়ে দলে যেতে চায়, তখন ধর্মদাস তাকে বলে-“আমরা বেণী ঘোষাল নই। আমাদের জন্মের ঠিক আছে।”
আকবর : পীরপুরের প্রজা আকবর। সে একজন মস্ত লাঠিয়াল। রমার জমিদারির বিরাট অংশ ছিল। সেই অংশে রক্ষার দায়িত্ব ছিল আকবরের। রমা তাকে বড়ো ভরসা ও বিশ্বাস করত। রমার কাছে সে ছিল একটা অবলম্বন। আকবর জাতিতে মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও সে ছিল ধর্মনিষ্ঠ। আকবর ছিল আত্মমর্যাদা সম্পন্ন একজন ব্যক্তি। আকবর বেণীর মতো লোককে তিরস্কার করত। আকবর ছিল বেতনপ্রাপ্ত লাঠিয়াল। তবে তার চরিত্রের মধ্যে কোন খাদ ছিল না। তার চরিত্রের সীমাবদ্ধতা থাকায় সে উজ্জ্বল আসনে মন্ডিত হয়েছে। আকবরের মুখে বেণীর তিরস্কার ফুটে উঠেছে-“খবরদার বড়বাবু, বেইমান কোয় না মোরা মোছলমানের ছ্যালে, সব সইতে পারি ও পারি না”
ভৈরব আচার্য : ভৈরব আচার্য ছিল তারিনী ঘোষালের অনুরাগী । এইজন্য বেশী ঘোষাল ও রমা তার ওপর রুষ্ট। কিন্তু রমেশের পিতা মারা যাবার পর দেখা যায়, ভৈরব আচার্য রমেশের জমিদারির অনেকাংশ আর্থিক ক্ষতি করেছে । আবার রমেশের নামে ফৌজ দারি মামলা করেছে। ভৈরবের নোংরা অভিযোগের ভিত্তিতেই রমেশকে কারাগারে বহুদিন থাকতে হয়েছিল।
অন্যানা চরিত্রগুলি : উপন্যাসে অন্যান্য চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন কুঁয়াপুর গ্রামের অন্যতম সমাজপতি পরাণ হালদার। আবার ব্রাক্ষণ সম্প্রদায়ের সমাজপতি ব্যক্তিকে পদবিধারী পদে সম্মান দিয়ে শরৎচন্দ্র সমাজের ব্রাক্ষণ ব্যক্তিদের প্রাধান্যকে নির্দেশ দিয়েছে। রমার মাসি এই উপন্যাসের অন্যতম এক চরিত্র। গ্রাম্য সমাজের একশ্রেনীর নারী যে কত নীচ, সংকীর্ণ ও কলহকারী তা রমার মাসির চরিত্রের মাধ্যমে লেখক দেখিয়েছেন। পরাণ হালদারের মতো নোংরা সমাজপতির মুখে পড়ে ক্ষেত্তিবামনি, আবার গোবিন্দ গাঙ্গুলীরও অপকর্মে যুক্ত এক ব্যক্তি । ন
উপন্যাসের অপ্রধান চরিত্রের মাধ্যমে গ্রাম্য সমাজের রূপটি লেখক দেখিয়েছেন। উপন্যাসের অপ্রধান চরিত্র প্রধান চরিত্রকে সমৃদ্ধ করে তোলে। ‘পল্লীসমাজ' উপন্যাসে অপ্রধান চরিত্রের মাধ্যমে সমাজের ঘৃণিতরূপটি সংস্কারের সুযোগ হয়েছে। তা অপ্রধান চরিত্রগুলির গুরুত্ব অবিস্মরনীয়।