উত্তর :-     ভূমিকা : আজকের তরুণরাই আগামী দিরেন দেশ ও জাতির কর্ণধার। তরুণ অর্থাৎ যুবসমাজই পারে শত বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে দেশকে স্বপ্নের দেশ হিসেবে গড়ে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সুবসমাজ এখন বিপথে পরিচালিত হচ্ছে। যুবসমাজের নানা সমস্যার কারণে তারা হতাশায় নিমজ্জিত। সুবসমাজের এ জাতীয় সমস্যা জাতির বুকে গভীর ক্ষত তৈরি করছে। গোটা সমাজকে ঠেলে দিচ্ছে অনিশ্চিত অন্ধকারের দিকে। আর এই সমস্যার প্রতিকার না হলে দেশ ও জাতি ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হবে।

 বর্তমান পরিস্থিতি : যুব সম্প্রদায় ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ। শুধু তাই নয়, চিন জনসংখ্যায় ভারতের থেকে বেশ খানিকটা এগিয়ে থাকলেও যুব সংখ্যায় ভারতই বিশ্ব সেরা ৷ ভারতের পরে যথাক্রমে চিন, ইন্দোনেশিয়া, আমেরিকা, পাকিস্তান। ভারতে এখন প্রতি তিনজনে একজন যুবক বা যুবতী। খুব শীঘ্রই ভারতীয়দের গড় বয়স হতে চলেছে ২৯ বছর। যুব সম্প্রদায়ের সংখ্যা ২০০১ সালে ছিল ৩৫ কোটি ৩০ লক্ষ, ২০১১ সালে হয় ৪৩ কোটি এবং ২০২১ সালে সেই সংখ্যা হবে ৪৬ কোটি ৪০ লক্ষ। সাধারণভাবে ১৩-৩৫ বছর কে যুব হিসাবে ধরা হলেও (National Youth Policy), কিছু কিছু ক্ষেত্রে উর্ধসীমা ৪০-ও ধরা হয়ে থাকে।

 সমস্যার প্রকৃতি :

বেকারত্ব : ভারতের অর্থনীতি বাকী দুনিয়ার চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে দৌড়াচ্ছে। তবে কর্মসংস্থান তৈরির ক্ষেত্রে রথের চাকা কিন্তু উল্টোদিকে ঘুরছে। ‘অর্গানাইজেশন অব্ ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট' (ওইসিডি) এর রিপোর্ট বলছে বর্তমান আর্থিক বছরে ভারতের অর্থনীতি ৭ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে একইসঙ্গে বলা হয়েছে যে ভারতে কর্মসংস্থানের হার কমেছে এবং তা কর্মক্ষম জনসংখ্যার হারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এগোচ্ছে না। ভারতের ৩০ শতাংশ যুব শক্তি যাদের বয়স ১৫-৩৫ বছরের মধ্যে, তাদের কর্মসংস্থানের কোনও ব্যবস্থা নেই। এমনকী শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষায়ও তারা পিছিয়ে রয়েছে। অর্থনৈতিক সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, এক্ষেত্রে চিনের চেয়ে ভারত তিনগুণ পিছিয়ে রয়েছে।

যুবসমাজ ও অবক্ষয় : অবক্ষয় শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ক্ষয়প্রাপ্তি। মানবজীবনকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে হলে কিছু গুণের প্রয়োজন হয়। আর মানুষের এই গুণগুলি যখনই লোপ পায় বা নষ্ট হয় তখনই শুরু হয় নৈতিক অবক্ষয়। কোনো একটি দেশের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হলো যুবসমাজ। তারা কখনও পরাজয় মেনে নেয় না এবং পুরাতনকে নতুন করে গড়তে চায়। কিন্তু এই যুবসমাজ যখন খারাপ পথে ধাবিত গোল্ডেন সাকসেস/সমাজবিদ্যা, পার্ট-২ (বি. এ. জেনারেল) । ১৫৩ হয় তখন সমাজের মধ্যে নানা সমস্যা দেখা দেয়। যুবসমাজের অবক্ষয়ের কারণে জাতীয়জীবনে নেমে আসে চরম দুঃখ-দুর্দশা, বিপর্যয় ও হাতাশা। 

 মূল্যবোধের অভাব : জীবনে সৎ, সুন্দর, কল্যাণকর ও শাস্তির মাধ্যমে বেঁচে থাকতে হলে কতগুলো গুণের প্রয়োজন হয়। আর এইসব গুণকেই সাধারণত মূল্যবোধ বলা হয়। সামাজিক ও ধর্মীয় এসব মূল্যবোধ যুবসমাজকে সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলের দিকে পরিচালিত করে। বর্তমান সমাজে এ সকল মূল্যবোধের অনুশীলন ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে। ফলে যুবসমাজ বিপথগামী হচ্ছে।

 রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব : ১৯৪৭ সালে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়। ১৯৭৭ সাল থেকে আমাদের দেশে ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে নানা ধরণের অস্থিরতা বিরাজ করেছে। এখনও দেশ রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। দেশের রাজনীতি ধীরে ধীরে পেশিশক্তি নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন বিপথগামী তরুণদের ব্যবহার করছে। আবার বিপথগামী তরুণরা স্থানীয় বা তার উপরের স্তরের নেতাদের প্রশ্রয় পেয়ে আরো বেপরোয়া হয়ে যায়। দুর্বল অর্থনৈতিক সমাজব্যবস্থাও যুব সমাজের অবক্ষয়ের জন্য অনেকাংশে দায়ী। আমাদের সমাজের অনেক ছেলেমেয়ে আছে যারা অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে লেখাপড়া করতে পারে না। এতে তারা শিক্ষার অভাবে নানা কুসংস্কার দ্বারা আচ্ছন্ন হয় এবং বিপথে ধাবিত হয়। তাই অর্থনৈতিক অভাবের কারণে যুবসমাজ তাদের নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে।

 অপসংস্কৃতির প্রভাব : আমদের সমাজের তরুণদের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ হলো বিদেশি সংস্কৃতির নামে এক ধরণের অপসংস্কৃতির প্রসার। বর্তমানে আমাদের চলচ্চিত্রের অশ্লীল নাচ, গান, সংলাপ যুবসমাজকে ক্রমান্বয়ে গ্রাস করে ফেলছে। টিভি, মোবাইল, বিশ্বায়নের হাত ধরে বিদেশি অপসংস্কৃতি আমাদের যুবসমাজকে চেপে ধরেছে। তাছাড়া রুচিহীন পোশাক-পরিচ্ছদও অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ।

 মাদকাশক্তির প্রভাব : আমাদের দেশের যেসব তরুণ-তরুণী লেখাপড়া শেষ করে চাকরি পায় না তারা নানারকম মানসিক হতাশায় ভোগে। চাকরির অভাবে তারা অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। দীর্ঘ সময় এই অবস্থা চলতে থাকলে তাদের ভেতরে ক্ষোভ জন্ম নেয়। আর এই ক্ষোভ থেকেই তারা চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, হত্যা ও অপহরণসহ নানা পাপ কাজে লিপ্ত হয়। আবার কোনো দেশের যুব সম্প্রদায় মাদকাসক্ত হওয়া মানে নৈতিক চরিত্রের চূড়ান্ত অধঃপতন। নানা ধরণের ড্রাগ, মদ, গাঁজা ইত্যাদি মাদকদ্রব্য সর্বত্র পাওয়া যায়। আর এ সুযোগ গ্রহণ করে যুবসমাজ ধ্বংস হচ্ছে।

 শিক্ষাঙ্গনের প্রভাব : শিক্ষা ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনা ও বিশৃংখলা অনেক সময় ছাত্র-ছাত্রীদের বিপথে পরিচালিত করে। ভর্তির সমস্যা, পরীক্ষা পিছিয়ে নেওয়া, ফল প্রকাশের বিলম্ব, সেশনজট এবং যখন তখন ধর্মঘট ইত্যাদি ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে মানসিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে। তাছাড়া যে সব প্রতিষ্ঠানে বোমাবাজি, ককটেলবাজি এবং মারামারি লেগেই থাকে সেসব প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের মনে সবসময় ভয়-ভীতি কাজ করে। আবার কখনও দেখা যায় যে, গুটিকয়েক সন্ত্রাসী সমস্ত ছাত্র সমাজকে কব্জা করে রাখে।

 যুবসমাজের অবক্ষয়ের প্রতিকার : কোনো দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে যুবসমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই যুবসমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিম্নে যুব সমাজের অবক্ষয়ের কিছু প্রতিকার সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

 পারিবারিক মূল্যবোধ : প্রতিটি মানুষই কোনো একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। শিশুকাল থেকে সে পরিবারেই বেড়ে উঠে। তারপর সে ধীরে ধীরে সমাজের সাথে পরিচিত হয় । শিশুদের মন শৈশবকালে কাদার মতো নরম থাকে। এই সময় তাদের ইচ্ছা মতো গড়ে তোলা যায়। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে পরিবারই পারে তাদের সন্তানদের উপযুক্ত মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে।

 শিক্ষার প্রসার ও শিক্ষাঙ্গণের সমস্যা সমাধান : আধুনিক সমাজব্যবস্থায় সুন্দরভাবে জীবনযাপনের অন্যতম শর্ত হলো শিক্ষা। তাই যুবসমাজকে অন্ধকার থেকে মুক্তির জন্য শিক্ষিত করা প্রয়োজন। দেশের প্রতিটি গ্রামে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়া উচিত। আবার যেসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ব্যবস্থায় ত্রুটি রয়েছে সেগুলো সমাধান করা উচিত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনার উপযুক্ত পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হলে সেশন জট নিরসন এবং উপযুক্ত সময়ে একাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পরীক্ষা নিতে হবে। এতে যুবসমাজের অবক্ষয় রোধ হবে।

বেকারত্ব হ্রাস ও দারিদ্র্য বিমোচন : আমাদের দেশের অনেক যুবকই বেকার। তাদের উৎপাদনশীল কাজে জড়িত করতে পারলে বেকারত্ব হ্রাস পাবে। আর বেকারত্ব হ্রাস পেলেই যুব সমাজের অবক্ষয়ও কমে যাবে। আবার যুব সমাজের অবক্ষয় থেকে মুক্তি লাভ করতে দরিদ্রতা দূর করতে হবে। দরিদ্র যুবকদের বিভিন্ন খাতে উৎপাদনশীল করে তোলার জন্য সরকারকে বিনা সুদে ঋণ ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

 ধর্মীয় মূল্যবোধ : ধর্মীয় মূল্যবোধই পারে মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে। যুব সমাজের বিরাট একটা অংশ ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে দূরে সরে আছে। তাই যুবসমাজকে অবক্ষয় থেকে মুক্তির জন্য ধর্মীয় শিক্ষা অপরিহার্য।

 সংস্কৃতির অবাধ প্রসার রোধ : যুব সমাজের অবক্ষয়ের পেছনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে অপসংস্কৃতি। যুবসমাজের বিশাল অংশ এখন বিদেশি সংস্কৃতির পথে ধাবিত হচ্ছে। এতে করে তাদের রুচি বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। তাই শিক্ষামুলক এবং সপরিবারে দেখার মতো চ্যানেলগুলো রেখে বাকি চ্যানেলগুলো বন্ধ করার জন্য সরকারের পদক্ষেপ নিজেদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে সচেষ্ট হতে হবে। 

      উপসংহার : অবক্ষয়কে একটি ভয়াবহ ব্যাধি বলা যায়। বর্তমানে এই ব্যাধি যুবসমাজকে গ্রাস করে ফেলছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে। তাই যুবসমাজকে অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আমাদের সকলেরই এগিয়ে আসা উচিত। যুবসমাজ সচেতন হলে দেশ ও জাতির উন্নয়ন সম্ভব হবে।