উত্তর :- যেকোনো রচনায় যিনি ঘটনাবলির নিয়ন্ত্রক তিনি নায়কপদে ভূষিত হন। সাধারণত উপন্যাসের ক্ষেত্রেও নায়ক বা নায়িকার স্থান সুউচ্চ শিখরে না হলেও তারা আমাদের খুব কাছের হলেও, আমাদের থেকে তাদের কিছু স্বাতন্ত্র থাকে। রচনার মূল কাহিনি তাদেরকে কেন্দ্র করে অগ্রসর হয়ে যায়। আর এই কাহিনিটি স্বাতন্ত্রভাবে এগিয়ে নিয়ে যায় নায়ক বা নায়িকা। ‘পল্লীসমাজ' উপন্যাসে কুঁয়াপুরের জমিদার তারিণী ঘোষালের একমাত্র পুত্র রমেশ প্রবাসে লেখাপড়া করতে যান। তাই তার গ্রামের সঙ্গে দীর্ঘদিন যোগাযোগ ছিল না।
পল্লীসমাজ
মানেই সহজসরল গ্রাম্য পরিবেশ। কিন্তু প্রবাস থেকে ফিরে এসে সে দেখে গ্রামের মাতব্বররা দরিদ্র, অশিক্ষিত মানুষের উপর অত্যাচার শোষন পীড়ন চালাচ্ছে। তাই তাদের সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে প্রতিষ্ঠা করাই মহত উদ্দেশ্য। গ্রামে ফিরে এসে তার পূর্বের স্মৃতিগুলি জ্বলজ্বল করছে। এই উপন্যাসে রমেশের জীবনচরিত্রের দুটি দিক পরিস্ফুটিত হয়েছে। সেগুলি হল-সমাজসংস্কার ও রমার সঙ্গে তার সম্পর্ক। রমেশের গ্রামীণ সমাজে অতীতের স্বপ্নময় জগৎ প্রবল ধাক্কা খায় বর্তমানের কঠোর বাস্তবিক সমাজের কাছে। সে দেখে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে জাতিভেদের দ্বন্দ্ব চলে এসেছে।
গ্রামের মধ্যেও এখন আর সেই অতীতের সরলতা বোধ নেই। খালি আছে দ্বন্দ্ব, ঝগড়া, ষড়যন্ত্র, মামলা, মোকদ্দমা । তাই দেখা গিয়েছে গোবিন্দ গাঙ্গুলির সঙ্গে খেন্তি বামনির ঝগড়া, যা দেখে রমেশের মাথা নীচু হয়ে গিয়েছিল। গ্রামের মানুষের এখন লোভের শেষ নেই। প্রত্যেক পরিবারে কলহে আর ঝগড়ায় গ্রামটি হয়ে উঠেছে কলুষতাযুক্ত। শুরু হয় প্রত্যেকে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। এসত্ত্বেও রমেশ গ্রামের মানুষের উন্নতিতে নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে গেছে। কিন্তু গ্রামের মানুষের বর্তমান সমাজের মতনই অকৃতজ্ঞ। তাই হতদরিদ্র মানুষের উপকার করতে গিয়ে দেখেছে যে, গ্রামের বেশীরভাগ মানুষই তাকে অবজ্ঞার চোখে দেখে।
ছোটো ব্যাপারেও কলহ করে। সামান্য স্বার্থ নিয়েও তারা পরস্পররের মধ্যে লড়াই করে। কুৎসিত ভাষা ব্যবহার করে। এই সমস্ত দিকগুলি দেখে রমেশের মনে হয়েছে, এরা যেন নীচতা ও স্বার্থপরতায় পরিণত হয়েছে। তাই সে গ্রাম ছেড়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু জ্যাঠাইমা বুঝিয়ে বলেন, গ্রামের বেশীরভাগ মানুষই অশিক্ষিত ও কুসংস্কারছন্ন মানসিকতা সম্পন্ন। তাই তাদের এমন আচরণ, তাই তারা এত দুঃখি, তাই তারা এত দুর্বল। এই সমস্ত জিনিস দেখে গ্রামে সমস্ত বিষয়টি বুঝতে সক্ষম হয় এবং তার রাগ প্রশমিত হয় ।
গ্রামে যেহেতু নিম্নশ্রেণির মানুষের প্রভাব রয়েছে। তাই তাদের উন্নতির দিকে রমেশ প্রভাব বিস্তার করে। হতদরিদ্র মানুষদের দুবেলা অন্ন জোগাড়ের ব্যবস্থা করে তাদের অন্তরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। সাধারণ মানুষের মধ্যে জ্ঞানের আলো জ্বালানোর জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। রাস্তা বাঁধিয়ে দেয়। সাপের কামড়ের ভয় থেকে রক্ষা করে। রমেশ এই গ্রাম্য সমাজকে মুখ থুবড়ে পড়ার থেকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে। হিন্দু-মুসলমানদের দ্বন্দ্বতে সে রুখে দাঁড়ায়। তাই রমেশ জেলে যাওয়ার পরও তার অবর্তমানে হিন্দু-মুসলিম ছেলেরা আলির বাড়িতে একত্রিত হয়ে নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে যায়। এই বিষয় থেকে রমেশের সংগঠন শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়।
রমেশের বোঝানোর ফলেই বেণীর প্রলোভনে পা না দিয়ে সনাতন হাজরা মন্তব্য করেন-“লোভে পড়ে যদি একাজ করি, মরলে আমাতে চুলোয় তোলা যাক, পা দিয়ে কেউ ছোবে না। সে দিনকাল আর নেই বড়োবাবু, সে দিনকাল আর নেই। ছোটোবাবু সব উলটে দিয়ে গেছে।” পল্লীসমাজ উপন্যাসে শরৎচন্দ্র দেখিয়েছেন ন্যায়ের কাছে সত্যের কাছে পরাভূত হল অন্যায়। রমেশের উদার ব্যক্তিত্বের জন্যই গ্রামে মাতব্বরদের কৌশল ষড়যন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ে। রমেশ আসার পরই সমাজটাকে সে সঠিক পথে অগ্রসর করে। কিন্তু উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে রমেশের উন্নয়ন উন্নতি কথার দিক ভেবেই কিশোর যতীনকে রমেশের হাতে তুলে দেয় এবং তাকে বলে যতীনকে তুমি তোমার মতো মানুষ কর। বড়ো হয়ে সে যেন তোমার মতোই স্বার্থ ত্যাগ করতে পারে হাসিমুখে। এই ভাবনার মধ্যে দিয়ে বোঝা যায় যে রমেশ কীভাবে পড়ে যাওয়া সমাজকে গড়ে তুলেছেন।
0 Comments